বিজ্ঞাপন
এই প্রেক্ষাপটে বিকল্প ভোট ব্যবস্থা হিসেবে "পিআর" বা Proportional Representation (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতির কথা উঠছে। এটি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে ভোটাররা দলকে ভোট দেন এবং যে দল মোট ভোটের যত শতাংশ পায়, সেই অনুপাতে তারা সংসদে আসন পায়। এতে একটি নির্দিষ্ট এলাকা নয়, বরং পুরো দেশকে একক ভোট এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে বড় দলের পাশাপাশি ছোট দল এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরও সংসদে কণ্ঠস্বর পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
পিআর পদ্ধতির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা রয়েছে। এটি ভোটের প্রকৃত প্রতিফলন নিশ্চিত করে, কারণ এখানে কোনো ভোট ‘নষ্ট’ হয় না। ছোট দলগুলোও তাদের সমর্থনের ভিত্তিতে আসন পেতে পারে, যা গণতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। সংখ্যালঘু এবং ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠীরাও এতে সরাসরি প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পায়। একইসঙ্গে, যেহেতু এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন, তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ, আপস ও জোট গঠনের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এতে রাজনৈতিক মেরুকরণ কিছুটা হলেও কমে আসে।
তবে এই পদ্ধতির চ্যালেঞ্জও কম নয়। পিআর পদ্ধতিতে একক দল খুব কমই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে, যার ফলে সরকার গঠনে সময় লাগে এবং জোট নির্ভরতা বাড়ে। একাধিক দলের সমন্বয়ে সরকার পরিচালিত হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতি দেখা দিতে পারে। জোট ভাঙলে ঘন ঘন নির্বাচন দিতে হয়, যা রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করে। পাশাপাশি, যেহেতু ভোট হয় জাতীয় পর্যায়ে, তাই নির্দিষ্ট এলাকার জনগণের সমস্যা ও দাবিগুলো সরাসরি সংসদে প্রতিফলিত হওয়ার সুযোগ কিছুটা কমে যায়।
বিশ্বের অনেক দেশেই পিআর পদ্ধতি চালু রয়েছে। ইউরোপে যেমন নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, জার্মানি (আংশিক); এশিয়ায় ইসরায়েল, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া; আফ্রিকায় দক্ষিণ আফ্রিকা ও নামিবিয়া এবং লাতিন আমেরিকায় ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় এ পদ্ধতি কার্যকর। ইসরায়েল একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ, যেখানে মাত্র ৩.২৫% ভোট পেলেও একটি দল সংসদে প্রবেশ করতে পারে। এতে ছোট দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হলেও, জোট সরকার প্রায়শই দুর্বল হয়, ঘন ঘন নির্বাচন হয় এবং ছোট দলগুলোর প্রভাব অতিরিক্ত বেড়ে যায়। ধর্মীয় দলগুলোও সরকারে চাপ তৈরি করে থাকে, যা সংস্কারমূলক সিদ্ধান্তে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, পিআর পদ্ধতি কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা মোকাবেলায় সহায়ক হতে পারে। যেমন—সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, সংখ্যালঘুদের কণ্ঠস্বর পাওয়া, রাজনৈতিক বিরোধী মতকে গুরুত্ব দেওয়া এবং নির্বাচনের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা। তবে এর বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সহনশীল সংস্কৃতি, জোট গঠনের সক্ষমতা এবং স্বচ্ছ নির্বাচনী কাঠামো। দেশের রাজনীতিতে এখনো ব্যক্তি-নির্ভরতা ও একক দখলের প্রবণতা থাকায় পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়ন সহজ হবে না।
পিআর পদ্ধতি নিঃসন্দেহে একটি অংশগ্রহণমূলক, ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক ভোট ব্যবস্থা গঠনের পথ দেখাতে পারে। তবে এটি বাস্তবায়নের আগে পর্যাপ্ত জনসচেতনতা, সাংবিধানিক সংস্কার এবং রাজনৈতিক পরিপক্বতা দরকার। বাংলাদেশে এটি সরাসরি বাস্তবায়নের বদলে ধাপে ধাপে, পরীক্ষামূলকভাবে কিছু আসনে প্রয়োগ করে ভবিষ্যতের জন্য একটি টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে।
-এমএসকে