ছবি: সংগৃহীত।।
বিজ্ঞাপন
পল্টু বিশ্বাসের গ্রেফতারে জনমনে কিছুটা স্বস্তি আসলেও তার সহযোগীরা বাইরে থাকায় সাধারণ মানুষের মনে চাপা আতঙ্ক এখনও রয়ে গেছে।
প্রতারক প্রদীপ বিশ্বাস (পল্টু) বহু অভিযোগ ও বিতর্কে জড়িত থাকার অভিযোগে সম্প্রতি আলোচনায় উঠে এসেছেন। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের পরিমাণ এবং প্রকৃতি সমাজের বিভিন্ন মহলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। তিনি একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। অন্যের মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট জাল করে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিলেন।
প্রদীপ বিশ্বাস পল্টু পেশাগত জীবনে রূপালী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। ব্যাংকে কর্মরত অবস্থায় তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের একাউন্ট থেকে বড় অঙ্কের অর্থ জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই অভিযোগ তৎকালীন গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসকের দপ্তর পর্যন্ত গড়ায়। এছাড়া জাল টাকার লেনদেনে সম্পৃক্ততার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে।
তথ্য অনুযায়ী, গোপালগঞ্জে অবস্থিত সোনালী বিড়ি কোম্পানির ব্যাংক একাউন্ট থেকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ জালিয়াতির ঘটনায় পল্টু বিশ্বাসের নাম সরাসরি জড়িত ছিল। এই বিষয়ে তার তৎকালীন ব্যাংক সহকর্মীদের মধ্যে অনেকেই বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করেন।
অভিযোগ এখানেই থেমে থাকেনি। গোপালগঞ্জ শহরের একজন বিশিষ্ট স্বর্ণ ব্যবসায়ী বরুণ দত্তের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ আরও গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়। অভিযোগ অনুযায়ী, বরুণ দত্ত ও তার স্ত্রীর ব্যাংক একাউন্টের স্বাক্ষরকৃত সম্পূর্ণ ফাঁকা চেকবই, ব্যবসায়িক চুক্তিপত্র, ব্ল্যাঙ্ক স্ট্যাম্প পেপার, ২১ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, নগদ লক্ষাধিক টাকা, পারিবারিক আসবাবপত্র ও দোকানের এসি প্রদীপ বিশ্বাস নিজের হেফাজতে রেখে দেন।
যখন বরুণ দত্ত তার মালামাল ফেরত চাইতে যান, তখন পল্টু বিশ্বাস তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি শুরু করেন বলে অভিযোগ। এতে করে একজন সম্মানিত ব্যবসায়ী শুধু আর্থিকভাবেই নন, মানসিকভাবেও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
অবসর গ্রহণের পর প্রদীপ বিশ্বাস পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন প্রতারণার সাথে—এমন অভিযোগ স্থানীয়দের। তার বিরুদ্ধে নারী কেলেংকারীসহ একাধিক সময় নৈতিক অবক্ষয়ের অভিযোগও উঠেছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিচয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে প্রতারণা চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এছাড়াও প্রদীপ বিশ্বাস পল্টুর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী গ্যাং পরিচালনার অভিযোগও রয়েছে। প্রদীপ বিশ্বাস পল্টু চাকরি দেওয়া ও বিদেশ পাঠানোর নাম করে বহু সাধারণ হিন্দু পরিবারের নিকট থেকে টাকা নিয়েছেন। ভুক্তভোগী নিরীহ হিন্দুরা টাকা ফেরত চাইলে প্রদীপ বিশ্বাস পল্টু তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে তাদেরকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
তার এই গ্যাং- এর অন্যতম সহযোগী ও মাস্টারমাইন্ড হলেন সাংবাদিক দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস সবুজ। দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস সবুজ একাধিক পেশা ও সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। তিনি একাধারে ‘শেয়ার বিজ’ এবং ‘দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদ’-এর গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি, পাশাপাশি এমপিওভুক্ত রঘুনাথপুর দীননাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। গোপালগঞ্জ কেন্দ্রীয় কালীবাড়ি ও জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের কমিটিতেও তিনি যুক্ত। হাইস্কুলের একজন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক যদি এতগুলো পদে থাকেন তাহলে তিনি স্কুলে কিভাবে সময় দেন? এত পদ সামলানোর পরে কিভাবে তিনি ছাত্রদের পাঠদান করেন, তা অত্যন্ত ভাবনার বিষয়।
তার সম্পর্কে বিস্তারিত অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি বর্তমানে যে স্কুলে শিক্ষকতা করেন সেটি তার নিজ গ্রামের স্কুল। যার দরুন স্কুলে বেশি সময় না দিলেও তাকে কোন জবাবদিহিতার মধ্যে পড়তে হয় না। গভর্নিং কমিটি তার পকেটে। তাই তিনি সর্বদা ব্যস্ত থাকেন সাংবাদিকতাসহ অন্যান্য রাজনৈতিক, সামাজিক কর্মকান্ডে। তিনি বর্তমানে প্রেসক্লাব গোপালগঞ্জের সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক। আসলে এতসব পদ ব্যবহার করে তিনি অনৈতিক অনেক সুবিধাসহ বিভিন্ন সংগঠনের তহবিল তছরুপ করছেন দেদারচ্ছে।
বিগত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সংখ্যালঘুদের নিয়ে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। এই সংগঠনের গোপালগঞ্জ শাখার বর্তমান সভাপতি প্রদীপ বিশ্বাস পল্টু ও সাধারণ সম্পাদক দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস সবুজ। প্রদীপ বিশ্বাস পল্টু গ্যাং এর মাস্টারমাইন্ড এই দুলাল বিশ্বাস সবুজ। পল্টু বিশ্বাসের সকল অনৈতিক-প্রতারণার কাজে পরামর্শদাতা হিসেবে সবসময় পাশে ছিলেন দুলাল বিশ্বাস সবুজ।
পল্টু গ্যাং এর আরেক প্রধান সহযোগী হলেন কত্থিত সাংবাদিক শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার। টুঙ্গিপাড়ার বাসিন্দা শৈলেন্দ্রনাথ নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি সংবাদের সাথে তেমন জড়িত নন। বরং তিনি ব্যস্ত থাকেন প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার কাজে। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত যাতায়াত, উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার, এবং এর আড়ালে অবৈধ কর্মকাণ্ড চালানোই তার প্রধান কাজ।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, শৈলেন্দ্রনাথ যশোরের নওয়াপাড়া উপজেলা থেকে প্রকাশিত একটি নামসর্বস্ব পত্রিকা দৈনিক গ্রামের কাগজ-এর একজন নামমাত্র সাংবাদিক। তিনি সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারের পরিবর্তে প্রশাসনের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কাছে কিশোরী ও যুবতী সরবরাহের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। অভিযোগ রয়েছে, এসব নারী সরবরাহের বিনিময়ে তিনি প্রশাসনের বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করেন এবং তার সাংবাদিক পরিচয় টিকিয়ে রাখেন।
অভিযোগ আছে, গোপালগঞ্জ সদর, সাতপাড়, গান্ধিয়াশুড় ও পাটিকেলবাড়ি এলাকায় বসবাসকারী দরিদ্র পরিবারের কিশোরীদের টার্গেট করে ভারতসহ বিভিন্ন জায়গায় পাচার করেন শৈলেন্দ্রনাথ। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এ কাজে লিপ্ত থাকলেও প্রশাসনের কিছু দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তার আশ্রয়ে থাকার কারণে তার বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
স্থানীয় সূত্র মতে, শৈলেন্দ্রনাথের অপরাধচক্রে বেশ কিছু নারীলোভী প্রশাসনিক কর্মকর্তা জড়িত, যারা তার কাছ থেকে নারী সরবরাহের বিনিময়ে তাকে নানা অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন।
শৈলেন্দ্রনাথের স্ত্রীও তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে জানা গেছে। বোড়াষি ইউনিয়নে নিজ বাড়িতে বসেই তিনি অবৈধ গর্ভপাত করিয়ে থাকেন। গোপনে গর্ভপাতের এই কাজ করে তিনি বিপুল অর্থ উপার্জন করছেন এবং একইসঙ্গে এইসব মেয়েদের দেহব্যবসায় জড়াতে বাধ্য করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গোপালগঞ্জের এক প্রবীণ সাংবাদিক জানান, “শৈলেনের এসব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমরা আগে থেকেই জানি। কিন্তু প্রশাসন যেখানে তার পক্ষে, সেখানে কিছু বলা কঠিন। ফলে আমরা চাইলেও তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারি না।”
অনেক সাংবাদিক প্রশ্ন তুলেছেন, কেবলমাত্র একটি মফস্বল পত্রিকার নামসর্বস্ব সাংবাদিক হয়েও কীভাবে শৈলেন্দ্রনাথ প্রেস এক্রিডিটেশন কার্ড পেয়েছেন? এটি পরিষ্কার, প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার আশীর্বাদেই তিনি এতদিন অপরাধ চালিয়ে যেতে পেরেছেন। পল্টু গ্যাং এর প্রশাসনিক সকল কাজের দেখভাল করেন এই শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার।
প্রদীপ বিশ্বাস পল্টু গ্যাং এর আরেক অন্যতম সদস্য হলেন মিহির বল। তিনি মূলত প্রদীপ বিশ্বাস পল্টুর লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করেন। প্রদীপ বিশ্বাস পল্টুর মামলা বাণিজ্যের প্রধান কুশীলব এই মিহির বল। জমি দখল, সাধারণ মানুষকে হুমকি-ধামকি, মিথ্যা মামলা দিয়ে ভোগান্তিসহ সকল প্রকার জাল-জালিয়াতিতে প্রদীপ বিশ্বাস পল্টুর প্রধান মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করে আসছেন মিহির বল।
প্রতারক প্রদীপ বিশ্বাস পল্টু, সাংবাদিক দুলাল বিশ্বাস সবুজ, সাংবাদিক শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার ও মিহির বলকে কেন্দ্র করে ওঠা এই গ্যাং এর ভয়ে গোপালগঞ্জের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ তথা সকল সাধারণ মানুষই তটস্থ। পুলিশের জালে প্রদীপ বিশ্বাস পল্টু ধরা পড়লেও সাংবাদিক দুলাল বিশ্বাস সবুজ, সাংবাদিক শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার ও মিহির বল এখনও অধরা। তাদেরকে এখন আইনের আওতায় আনা গেলে গোপালগঞ্জবাসীর মনে সত্যিকারের স্বস্তি মিলবে।
জনপ্রিয়
বিজ্ঞাপন
পরবর্তী সংবাদ লোড হচ্ছে...