বিজ্ঞাপন
সাংগঠনিক কার্যক্রমে অনুপস্থিত থাকলেও এসব নেতাদের পদ-পদবী লেনদেন এবং কমিটি গঠনে অতিসক্রিয়তা বিএনপির ত্যাগী ও মূলধারার নেতাদের মধ্যে উদ্বেগ ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
দলের দুঃসময়ে কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি এসব সুবিধাবাদী নেতাদের। কিন্তু বর্তমানে তারা নিজেদের ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে ভাবতে শুরু করে জড়িয়ে পড়েছে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে। গোপালগঞ্জের তৃণমূল বিএনপি নেতাদের ভাষায়, এদের কেউই দলের ভেতর থেকে গড়ে ওঠেননি—রাজনীতিতে তারা বহিরাগত, ‘সুবিধাবাদী’, ‘টাউট’-‘বাটপার’ হিসেবেই পরিচিত। জেলা বিএনপি’র নিয়ন্ত্রণ এখন এই চান্দা ভাইদের দখলে। আর এই টাউট-বাটপারদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বিএনপি’র এক কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে।
বর্তমানে গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অনুপস্থিতিতে এই ‘দুধের মাছি’দের দৌরাত্ম্য বেড়েছে বহু গুনে। হালুয়া-রুটির ভাগ বসাতে এখন তারা জেলা বিএনপির অভ্যন্তরে ব্যাপক সক্রিয়। এর ফলে জেলার আদি ও প্রকৃত বিএনপি নেতৃত্ব আজ কোণঠাসা। সম্প্রতি গোপালগঞ্জ সদর, কাশিয়ানী ও মুকসুদপুর উপজেলায় ইউনিয়ন, পৌর ও উপজেলা কমিটি অনুমোদন দিয়েছে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি। এসব কমিটিতে দলের দুঃসময়ের পরীক্ষিত কর্মীদের না রেখে, অতীতে আওয়ামী লীগের আশপাশে থাকা তৃতীয় সারির পাতিনেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে—এমন অভিযোগ দলের তৃণমূলকর্মীদের।
আগামী ৫ জুলাই (শনিবার) জেলা বিএনপির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দলীয় ত্যাগী নেতাদের প্রত্যাশা অনেক। কারণ, ১৬ বছর পর এই প্রথম এমন সম্মেলন হতে যাচ্ছে। সদ্য ঘোষিত বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিগুলোর গঠনের ধারা দেখে নেতাকর্মীদের আশঙ্কা, জেলা কমিটিতেও একই ধরনের বহিরাগত, সুবিধাবাদী, টাউট-বাটপারদের আধিপত্য থাকবে।
একইসঙ্গে অভিযোগ রয়েছে, এই সুবিধাভোগী নেতাদের একাংশ ঠিকাদারি কাজ, তদবির, অবৈধ দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মে সরাসরি লিপ্তরয়েছে। আদালত চত্বর, প্রকৌশল অফিস, হাসপাতালসহ শহরের বিভিন্ন সরকারি অফিসে আশঙ্কাজনকভাবে সর্বত্র এদের দৌরাত্ম বেড়ে গেছে। এলাকা ভিত্তিক সরকারি অফিসগুলোকে দখলে নিয়ে রেখেছেন বিএনপি নামধারী এসব বহিরাগত টাউট-বাটপাররা। এদের কারণেই জেলা বিএনপির অভ্যন্তরে শুরু হয়েছে কলহ ও বিভাজন।
গত বছর ১৩ সেপ্টেম্বর ঘোনাপাড়া মোড়ে একটি পথসভাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে নিহত হন স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা শওকত আলী দিদার এবং আহত হন কেন্দ্রীয় সভাপতি এস এম জিলানী। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় নাম-বেনামে ১৬১৮ জনকে আসামি করা হয়, যা পরবর্তীতে একাংশের সুবিধাবাদী বিএনপি নেতাদের ব্যাপক চাঁদাবাজির হাতিয়ার হয়ে ওঠে। মামলা দিয়ে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগও রয়েছে।
দলীয় দুঃসময়ে যেসব নেতারা গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির হাল ধরেছিলেন, নিজেদের সম্মান বাঁচাতে আজ তারা দূরে সরে আছেন। এফ ই শরফুজ্জামান জাহাঙ্গীর ছিলেন গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির নেতৃত্বের প্রতীক। তার পিতা ফায়েকুজ্জামান অবিভক্ত পাকিস্তানের এম.এল.এ ও চাচা ওয়াহেদুজ্জামান ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। সর্বমহলে ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত এই নেতা ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে গোপালগঞ্জ-১ আসন থেকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে তার ছেলে বর্বরোচিত হামলার শিকার হন। ওই ঘটনায় তার ছেলে কয়েক বছর কোমায় থেকে আজও সুস্থ হতে পারেননি। সেই দু:খ বুকে নিয়েই এফ ই শরফুজ্জামান জাহাঙ্গীর রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন।
তার মতোই আদি নেতৃত্বের আরও অনেক নেতাই আজ অবহেলিত। যেমন: যেমন: মনিরুজ্জামান পিনু, সাইফুর রহমান নান্টু, মিজানুর রহমান মিজান, এ্যাড. কাজী আবুল খায়ের, মুশফিকুর রহমান রেন্টু মিয়া, এম এইচ খান মঞ্জু, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শরীফ-ই-রফিকুজ্জামান (রাফীক শরীফ), কাজী নিয়ামুল হক, সার্জেন্ট হেলাল উদ্দিন, মারুফ হোসেন এলিট, আলী নসর খান টিটন, ময়েনুর রহমান হিটু, মিজানুর রহমান খান ছোট মনি, নাজমুল কবির, রেজাউল করিম বাদল, অশোক কাপালি, দীপঙ্কর সাহা, সাংবাদিক হুমায়ুন কবির, সৈয়দ কামরুজ্জামান টুটুল (ভিপি টুটুল), মঈনুল ইসলাম স্বপন, মাহাবুব হোসেন সারমাত, চৌধুরী মঞ্জুরুল ইসলাম (সাবেক ভিপি), এ্যাড. সাজ্জাদুল ইসলাম রিপন, এ্যাড. সরদার তৌফিকুল ইসলাম, আনিচুর রহমান পিটার, ফজলুল কবির দারা, রিয়াজুল হাসান নাসিম, সৈয়দ হারুন অর রশিদ স্বপন, মতিউর রহমান পিয়াস, শেখ সদরুল আলম মুকুল, এম মাহাবুব আলী সোহেল, আশরাফুল ইসলাম বিমান, যুবদলের জেলা সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন লিপটন, হাসিবুর রহমান হাসিব, কবিরুল শেখ, এস এম জিয়াউল কবির বিপ্লব প্রমুখ। এছাড়াও গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপিতে আরো অনেক নাম না জানা পুরানো ত্যাগী নেতা আছেন, যারা পদ-পদবীর জন্য রাজনীতি করেন না। তারা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শকে বুকে ধারণ করে দলের স্বার্থে নীরবে রাজনীতি করছেন।
নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে এইসব নেতাদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। কিন্তু আজ সেই অবদান বিস্মৃত হয়ে গেছে জেলা বিএনপির সুবিধাবাদী বহিরাগত টাউট-বাটপারদের দাপটে।
বর্তমানে গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপি’র সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং জনসমর্থন জামায়াতের চেয়েও দুর্বল বলে মনে করছেন জেলার সাধারণ জনগণ। দলীয় কাঠামো ছাড়াই এখন বিশৃঙ্খলভাবে চলছে সাংগঠনিক কার্যক্রম।
এই পরিস্থিতিতে বিএনপির পোড় খাওয়া, ত্যাগী নেতারা আশা করছেন- দলকে বাঁচাতে এবং সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গোপালগঞ্জ জেলার দায়িত্বে এফ ই শরফুজ্জামান জাহাঙ্গীরের মতো অভিজ্ঞ ও সম্মানিত নেতাকে ফের যুক্ত করবেন, যিনি পারবেন দলের ভিতরে ঐক্য এবং আস্থা ফিরিয়ে আনতে।
আগামী ৫ জুলাই জেলা বিএনপি’র দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে যে নতুন কমিটি গঠণ করা হবে, সেখানে দলের পুরানো ত্যাগী নেতাদের মধ্যে সভাপতি পদ প্রার্থী হিসেবে আছেন এফ ই শরফুজ্জামান জাহাঙ্গীর, এ্যাড. কাজী আবুল খায়ের, শরীফ-ই-রফিকুজ্জামান এবং সাধারণ সম্পাদক পদ প্রার্থীদের মধ্যে আছেন সৈয়দ কামরুজ্জামান টুটুল (ভিপি টুটুল), চৌধুরী মঞ্জুরুল ইসলাম (সাবেক ভিপি), এ্যাড. সরদার তৌফিকুল ইসলাম।
৫ জুলাই বিএনপি’র দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনকে ঘিরে শহরজুড়ে এখন সাজ-সাজ রব। কেন্দ্রীয় নেতাদের বরণ করতে নেওয়া হয়েছে নানা প্রস্তুতি। জেলার নেতা-কর্মী সবাই এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। আর জেলাবাসী আশা করছেন দলের পোড় খাওয়া, ত্যাগী, আদি নেতারাই আসবেন বিএনপির আগামী কমিটিতে এবং নতুন কমিটি হবে সুবিধাভোগী, টাউট-বাটপার মুক্ত। এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছে গোপালগঞ্জ জেলাবাসী।