বিজ্ঞাপন
এরপর চিকুনগুনিয়ার পরীক্ষা করাতে গিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। কমপক্ষে দশটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরেও চিকুনগুনিয়ার পরীক্ষা করাতে পারেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত তাকে বেসরকারি একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে রোগ নির্ণয় ছাড়াই চিকিৎসা নিতে হয়।
এমন অভিজ্ঞতা শুধু জিনাতের নয়। সঠিক রোগ নির্ণয়ের অভাবে বহু রোগী এখন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কারণ, সরকারি হাসপাতালগুলোতে গত ৮ বছর ধরে চিকুনগুনিয়ার পরীক্ষা এক প্রকার বন্ধ।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর,বি জানিয়েছে, চলতি জুন মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে রাজধানীতে জ্বর ও উপসর্গ নিয়ে পরীক্ষা করাতে আসা ১৭১ জন রোগীর মধ্যে ১৪০ জনের শরীরে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে— শনাক্তের হার প্রায় ৮২ শতাংশ। সংস্থাটি একে উচ্চ সংক্রমণের স্পষ্ট ইঙ্গিত হিসেবে চিহ্নিত করে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
২০১৭ সালে ঢাকায় প্রথম বড় আকারে চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। আইসিডিডিআরের হিসাবে সে বছর অন্তত ১৩ হাজার রোগী শনাক্ত হলেও বাস্তবে সংখ্যাটি লাখ ছাড়িয়েছে বলে ধারণা গবেষকদের। এরপর একে ‘কম গুরুত্বের রোগ’ ঘোষণা করে সরকারি হাসপাতালগুলোতে এর পরীক্ষার কিট সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, মৃত্যু প্রায় নেই বলে কিট কেনার প্রয়োজনীয়তা আর দেখা দেয়নি।
২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় করা এক জরিপে দেখা গেছে, চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। আইসিডিডিআর,বি, কিল ইউনিভার্সিটি (যুক্তরাজ্য) এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় ৩৯৪ জন উপসর্গধারী রোগীর নমুনা বিশ্লেষণে ১৩৮ জনের (৩৫%) শরীরে ভাইরাসটি ধরা পড়ে।
এই ১৩৮ জনের মধ্যে ৯৮.৫ শতাংশ ঢাকাবাসী। দক্ষিণে ৫২ শতাংশ, উত্তরে ৪৬ শতাংশ। আক্রান্তদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ পুরুষ, ৩৫ শতাংশ নারী। ৮৩ শতাংশ রোগীর বয়স ৩০ বছরের বেশি।
রোগীদের ৯৬ শতাংশ ভুগেছেন গিঁটে ব্যথায়, ২৯.৪ শতাংশ ক্লান্তিতে, ১৯ শতাংশের অস্থিসন্ধি ফুলে গেছে। এমনকি ৮১ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে ২৮ দিন পরও উপসর্গ বিদ্যমান ছিল।
গবেষকদের মতে, এই রোগের দীর্ঘস্থায়ী উপসর্গের কারণে কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। গড়ে প্রতিটি আক্রান্ত ব্যক্তি হারাচ্ছেন ১০.৫ কর্মদিবস, যার আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৮ হাজার টাকা।
গবেষণা কার্যক্রমের প্রধান ডা. মো. আব্দুল্লাহ ওমর নাসিফ বলেন, এপ্রিল থেকে নিয়মিতভাবে পজিটিভ কেস পাওয়া যাচ্ছে। সামনের মাসগুলোতে ডেঙ্গু মৌসুমে চিকুনগুনিয়াও বড় আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ঈদে মানুষ যেভাবে চলাচল করেন, তাতে ভাইরাসটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবেদ হোসেন খান বলেন, দেশে দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত থাকা ভাইরাস জ্বরগুলো আবারও মাথাচাড়া দিচ্ছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু।
ডা. আবেদ বলেন, ২০১৭ সালের পর আবারও চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ২০২৪ সালের ১৯ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ৫২০ জন সন্দেহভাজন রোগীর মধ্যে ১৬১ জনের শরীরে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। গিঁটে ব্যথা, ত্বকে র্যাশ ও দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতা— এই উপসর্গগুলো রোগীর দৈনন্দিন জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে।
বর্ষা শুরুতেই ডেঙ্গু সংক্রমণও বেড়েছে। জুন মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন অন্তত ১,৮৭৭ জন। বরিশাল জেলাতেই মারা গেছেন ৫ জন। এবার সংক্রমণে তিনটি সেরোটাইপ (DEN-1, DEN-2, DEN-3) শনাক্ত হয়েছে, যা জটিলতা বাড়াচ্ছে।
নিপসমের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ডা. গোলাম ছারোয়ার বলেন, ইনসেকটিসাইড ছিটানো হলেও সেটি কতটা কার্যকর, সে বিষয়ে কোনো বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন নেই। অনেক ক্ষেত্রে ভুল কৌশলে বা ভুল দূরত্বে ছিটানোর ফলে কার্যকারিতা হারাচ্ছে।
তিনি বলেন, “আপনার হাতে যদি বন্দুক থাকে, কিন্তু গুলি হয় খেলনার, তাহলে সেই গুলিতে কি আপনি শত্রু মারতে পারবেন?”
এডিস মশার দুই প্রজাতি বাংলাদেশে বিস্তৃত— একটি ছায়াযুক্ত জায়গায় থাকে, অন্যটি খোলা জায়গায়। এই ভিন্ন আচরণের জন্য ভিন্ন কৌশল প্রয়োজন হলেও তা অনুসরণ করা হচ্ছে না।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যু কম হলেও এটি রোগীর জীবনে দীর্ঘমেয়াদী ভোগান্তি সৃষ্টি করে। এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই, ফলে উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসাই একমাত্র পথ। তবে সেজন্য প্রয়োজন রোগ শনাক্ত করা, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হচ্ছে না।
তিনি বলেন, “চিকুনগুনিয়াকে ‘হালকা’ ভাইরাস জ্বর হিসেবে অবহেলা করা এক ধরনের ঝুঁকি। কারণ, এটি মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত করে দিতে পারে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, সরকারি হাসপাতালে এখন চিকুনগুনিয়ার নিয়মিত পরীক্ষা হয় না। তবে আইইডিডিআর ও রেফারেন্স ল্যাবগুলোতে পরীক্ষার সুযোগ আছে। সন্দেহভাজন রোগীদের নমুনা পাঠানো হয়।
তিনি আরও বলেন, “সবকিছুই যদি টেস্টের ওপর নির্ভর করে, তাহলে তো চিকিৎসকদের ভূমিকা থাকছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ কনসালটেন্টরা রোগীর উপসর্গ দেখে রোগ নির্ণয় করতে পারেন।”
পরিশেষে তিনি বলেন, “চিকুনগুনিয়া আর ডেঙ্গু অনেকটাই কাছাকাছি। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাও প্রায় একই। তাই সবাইকে পরীক্ষা করতে হবে— এমন বাধ্যবাধকতা নেই।”