বিজ্ঞাপন
হামাসের প্রতি তার সহমর্মিতা, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তৃতা এবং মুসলিম উম্মাহর পক্ষে দৃশ্যমান অবস্থান তাকে ইসলামপন্থীদের মাঝে জনপ্রিয় করে তোলে। কিন্তু সাম্প্রতিক তথ্য ও বিশ্লেষণে উঠে এসেছে ভিন্ন এক চিত্র—এক ভয়ংকর রাজনৈতিক দ্বিচারিতা।
মুখে ফিলিস্তিনপ্রীতি, পেছনে ইসরায়েলের সঙ্গে ব্যবসা?
২০০৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর ইসলামপন্থীদের মধ্যে এরদোয়ানকে নিয়ে ব্যাপক উচ্ছ্বাস দেখা দেয়। অনেকে তাকে ‘খিলাফতের প্রতীক’ হিসেবে কল্পনা করেন। তবে সময়ের সাথে সাথে এরদোয়ান ধীরে ধীরে এক কর্তৃত্ববাদী শাসকে রূপান্তরিত হন।
তিনি তুরস্কের পার্লামেন্টভিত্তিক সরকারব্যবস্থা বদলে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি চালু করেন, বিরোধীদের দমন করেন, এবং গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে আনেন।
গাজায় ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে তার বক্তৃতা ছিল আগ্রাসী—নেতানিয়াহুকে ‘হিটলারের সঙ্গে তুলনা’ করেছিলেন তিনি। এমনকি তিনি হামাসকে “মুক্তির সংগঠন” বলেও অভিহিত করেছিলেন। এসব বক্তৃতা ইসলামপন্থী ভোটারদের প্রশংসা পেলেও বাস্তবে কার্যকর পদক্ষেপ ছিল অনুপস্থিত।
২০২৪ সালে ‘বাণিজ্য বন্ধ’ ঘোষণা, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি!
২০২৪ সালের মে মাসে, গাজার মানবিক সংকটের অজুহাতে এরদোয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তদন্তে দেখা যায়, তুরস্ক থেকে পণ্য এখনো ইসরায়েলে যাচ্ছে—কখনো সরাসরি, আবার কখনো “ফিলিস্তিন” নামে চালান পাঠিয়ে।
সাংবাদিক মেতিন চিহান-এর অনুসন্ধান অনুযায়ী, এমনকি এরদোয়ানের ছেলে নিজেও ওই সময় ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অর্থাৎ, সরকারের মুখে ইসরায়েল বিরোধিতা থাকলেও বাস্তবে রয়েছে গভীর সম্পর্ক।
ভূ-রাজনৈতিক সহযোগিতা: ন্যাটোর সদস্যপদ ও সিরিয়ায় ডিল
তুরস্ক সরাসরি গাজা যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত না হলেও, তাদের ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকা ও ন্যাটোর সদস্যপদ ইসরায়েলের জন্য কৌশলগত সহায়তার কাজ করছে। সিরিয়ায় ইসরায়েলি অভিযানের সময় তুরস্কের সঙ্গে ‘ডিকনফ্লিকশন মেকানিজম’ চালু ছিল, যা ইসরায়েলের অপারেশন আরও সহজ করেছে।
তুরস্কের এই কৌশলগত সমন্বয় অনেক বিশ্লেষকের মতে, গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন ঠেকাতে মুসলিম বিশ্বের ঐক্য গঠনের পথে বড় অন্তরায়।
‘রিং অফ ফায়ার’ ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ: সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা?
বিশ্লেষকরা এরদোয়ানের সবচেয়ে বড় ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে দেখছেন সিরিয়ায় তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকা।
ইরান দীর্ঘ ২০ বছর ধরে গড়ে তুলেছিল একটি ‘রিং অফ ফায়ার’—যার মাধ্যমে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেন হয়ে ইসরায়েলকে ঘিরে ফেলার সামরিক কৌশল ছিল। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, গাজা যুদ্ধের সময়, তুরস্ক সমর্থিত নেতা আহমেদ হুসেইন আল-শারাকে সিরিয়ার ক্ষমতায় বসিয়ে সেই রিং ধ্বংস করে দেয়।
আল-শারা ছিলেন আল-নুসরা ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠাতা, যিনি আগে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বন্দি ছিলেন। তার ক্ষমতায় আসা হিজবুল্লাহর অস্তিত্ব সংকটে ফেলেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এরদোয়ানের দ্বিচারিতা: একদিকে ফিলিস্তিনপ্রেম, অন্যদিকে নিজের স্বার্থরক্ষা
অনেকেই মনে করছেন, এরদোয়ানের এই সব পদক্ষেপ মূলত তার ক্ষমতা ধরে রাখা ও নিজের রাজনৈতিক অবস্থান সংহত করার জন্য। ইসলামপন্থী ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখতে তিনি মুখে মুসলিম ঐক্য ও ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলেন, কিন্তু আড়ালে ইসরায়েলের সঙ্গে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি এক প্রকার ভণ্ডামি, যা শুধু মুসলিম বিশ্বের জন্য লজ্জাজনক নয়, বরং ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা।
একদিকে মানবিক সহানুভূতি ও মুসলিম সংহতির কথা বলে, অন্যদিকে ইসরায়েলকে পরোক্ষ সহায়তা করে এরদোয়ান এক জটিল রাজনৈতিক দ্বিচারিতার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
মুসলিম বিশ্বে তার প্রতি যারা ভরসা রেখেছিলেন, তাদের জন্য এই বাস্তবতা হতাশার—ফিলিস্তিনের রক্তের দাগে এখন এরদোয়ানের হাতও দাগি বলে মনে করছেন অনেকে।
সূত্র: মুসলিম মিরর, মেতিন চিহান ।