ছবি : রিপন মিয়া (ভোরের বাণী গ্রাফিক্স)
বিজ্ঞাপন
রিপন মিয়ার উত্থান হঠাৎ নয়। নেত্রকোণার এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া এই তরুণ নিজের সুতোয় বাঁধা গতানুগতিক জীবনের বাইরে গিয়ে নিজের অযোগ্যতা ও অদক্ষতাকে ছাপিয়ে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে একান্তই সাদামাটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও গল্প শেয়ার করে হাসিতামাশা ও বিভিন্ন অশুদ্ধ ইংরেজি ডায়লগ কিছু ছন্দ—এসব মিলিয়ে ধীরে ধীরে তিনি পরিচিতি অর্জন করতে শুরু করেন।
রিপনের জনপ্রিয়তা মূলত তার সরলতা, খোলামেলা স্বভাব, এবং স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কনটেন্টের কারণে। অনেকে তাঁকে “আমাদের এলাকার ছেলে” হিসেবে দেখেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ভিডিও, লাইভ, এবং ছোট গল্পগুলো মানুষের কাছে সহজবোধ্য, হৃদয়স্পর্শী এবং বিনোদনমূলক।
কিন্তু যেমনটা বলা হয়ে থাকে, জনপ্রিয়তার সাথে সমালোচনাও আসে। আবার অনলাইনের সস্তা জনপ্রিয়তা খুবই ক্ষণিকের। সাম্প্রতিক সময়ে রিপন মিয়ার নাম জড়িয়ে সামাজিক মিডিয়ায় শুরু হয়েছে নানা বিতর্ক। কেউ তাঁর পুরনো কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, কেউ আবার অভিযোগ করছেন যে তিনি জনমত তৈরি করার জন্য নাটকীয়তা সৃষ্টি করছেন। আবার অনেকে বলছেন, “রিপন মিয়া মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হয়েছেন”—কারণ কোনো প্রমাণ ছাড়াই নানা মন্তব্য ও ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যা জনমনের দিক পরিবর্তন করেছে।
বাংলাদেশের অনলাইন সমাজে মিডিয়া ট্রায়াল একটি নতুন বাস্তবতা। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ব্যক্তিগত জীবন, কর্মকাণ্ড, কথোপকথন— সবকিছু মুহূর্তের মধ্যে কোটি মানুষের সামনে চলে আসে। যাচাই-বাছাই ছাড়া তথ্য প্রকাশ, মতামতের ঢেউ—সব মিলিয়ে কখনও কখনও একজন মানুষকে সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রিপনের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটছে বলে মনে হয়।
রিপনের বিরুদ্ধে উঠে আসা অভিযোগগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিষয় ইতোমধ্যেই যাচাই করা হয়েছে, কিন্তু কিছু অভিযোগ এখনও অজানা। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর ভিডিও এবং পোস্টগুলোর মন্তব্য বিভাগের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সমালোচনার পাশাপাশি যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ তাঁকে সমর্থনও জানাচ্ছেন। ফলে একটি দ্বৈত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
তাঁর উত্থান এবং বিতর্কের মাঝে আমরা দেখতে পাই সমাজের এক ধরণের অস্থিরতা। আমরা চাই “স্থানীয় ছেলে” সফল হোক, কিন্তু একই সঙ্গে তাকে নিয়ে সমালোচনাও করি—যা স্বাভাবিক। তবে মূল প্রশ্ন হল, আমরা কতটা নিরপেক্ষ? আমরা কি যাচাই না করে মানুষকে দোষারোপ করছি? রিপন মিয়া কি নিজের জনপ্রিয়তার ছায়ায় এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন, যেখানে সত্য আর ভুলের সীমানা মিশে গেছে?
রিপন মিয়ার সামাজিক প্রভাবও উল্লেখযোগ্য। তাঁর কিছু ভাইরাল হওয়া ডায়লগ যেমন যুবকদের স্বাভাবিক বিনোদনের প্রতি আগ্রহী করে। সবই নেত্রকোণার যুব সমাজকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু সমালোচনা ও বিতর্কের মধ্যে এই প্রভাব কিছুটা বিস্তৃতি হারাচ্ছে।
একটি বিষয় লক্ষণীয়—রিপন মিয়ার বিতর্ক অনলাইনে যেমন তীব্র, তেমনই তা বাস্তব জীবনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়। অনেক মন্তব্য এবং সমালোচনা শুধু ভিউ ও ভাইরালের জন্য তৈরি। এটি প্রমাণ করে যে আজকের সোশ্যাল মিডিয়া সমাজে কোনো ব্যক্তির নাম, পরিচয় বা কর্মকাণ্ড কত দ্রুত জনমত তৈরি করতে পারে এবং ঠিক কতটা অসত্য তথ্যের ভিত্তিতেই মানুষকে বিচার করা হয়।
এই অবস্থায় রিপন মিয়ার পক্ষে সমর্থকদের বলার মতো একটি বিষয় রয়েছে—তাঁর লক্ষ্য সবসময় ইতিবাচক। কোনো ভুল হলেও তা তার চরিত্রের পূর্ণ রূপ নয়। আমাদের উচিত তরুণদের ভুল ধরিয়ে দেওয়া, কিন্তু পুরো জীবনকেই বিতর্কের খাতায় লিখে ফেলা নয়।
রিপন মিয়া নেত্রকোণার এক সন্তান। তাঁর উত্থান, জনপ্রিয়তা, বিতর্ক— সবই আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি। তাঁর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর। আমরা যদি তাকে শুধুমাত্র সমালোচনা করি, তবে নতুন প্রজন্মের উদ্যম নষ্ট হবে। কিন্তু সমর্থন ও সতর্ক পরামর্শ দিয়ে আমরা তাকে সঠিক পথে এগোতে সাহায্য করতে পারি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় তার নাম ঘিরে যতটুকু বিতর্ক হয়েছে, তা হয়তো সময়ের সাথে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হবে। কিন্তু নেত্রকোণার মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব, ব্যক্তি হিসেবে তাকে বিচার করার আগে, তথ্য যাচাই ও বাস্তব প্রেক্ষাপট বোঝা। অতএব আমার প্রশ্নটি এখন প্রাসঙ্গিক : মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার নয়তো রিপন মিয়া?
রিপনের গল্প শুধু ব্যক্তির নয়—এটি আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, আমাদের বিচারের মানদণ্ড। যদি আমরা নতুন প্রজন্মের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যমকে সমর্থন না করি, তাহলে সামনের দিনের নেত্রকোণার তরুণরা কি ভবিষ্যতে কোনো সামাজিক নেতৃত্ব নিতে পারবে? রিপন মিয়ার মতো তরুণদের ভুল থেকে শেখার সুযোগ দেওয়া উচিত, বিতর্কের জন্য নয়।
জনপ্রিয়
বিজ্ঞাপন
পরবর্তী সংবাদ লোড হচ্ছে...