প্রতীকী ছবি।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপনটিতে দাবি করা হয়, ঘরে বসে প্রতিদিন বিজ্ঞাপন দেখে মাসে ১০ হাজার টাকা আয়ের সুযোগ আছে। এর জন্য শুরুতেই ১০ হাজার টাকা ওয়েবসাইটটির অ্যাকাউন্টে জমা করতে বলা হয়।
প্রলুব্ধ হয়ে ওই শিক্ষার্থী একটি মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) মাধ্যমে উল্লিখিত পরিমাণ অর্থ পাঠান। এরপর নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেখলেও কিছুদিন পর তাঁর অ্যাকাউন্ট ‘ব্লক’ করে দেওয়া হয় এবং পুনরায় চালুর জন্য অতিরিক্ত পাঁচ হাজার টাকা দাবি করা হয়। সন্দেহ হলে বন্ধুদের সহায়তায় অনুসন্ধান করে তিনি জানতে পারেন, এটি একটি প্রতারণামূলক ওয়েবসাইট। কিন্তু আর অর্থ ফেরত পাওয়া সম্ভব হয়নি।
এই ধরনের প্রতারণার শিকার শুধু এই শিক্ষার্থী নন। ফেসবুকে প্রতিনিয়ত বিজ্ঞাপন প্রচার করে চালানো হচ্ছে এমন শতাধিক প্রতারণামূলক ওয়েবসাইটের প্রচারণা। বিষয়টি নিয়ে অনলাইন ভেরিফিকেশন ও মিডিয়া গবেষণা প্ল্যাটফর্ম ডিসমিসল্যাব একটি গবেষণা প্রকাশ করেছে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, এসব ওয়েবসাইটের ডোমেইন নাম, হোস্টিং এবং আইপি ঠিকানায় মিল পাওয়া গেছে—যা প্রমাণ করে, এর পেছনে একটি সংঘবদ্ধ চক্র কাজ করছে। এই চক্রটি বারবার নতুন নামে ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইট তৈরি করে সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে।
ডিসমিসল্যাবের গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র দুই দিন 'অ্যাড দেখে ইনকাম করুন' ও 'ইনকাম ওয়েবসাইট' কীওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করে তারা ৩১টি ফেসবুক পেজ ও ২৫টি ওয়েবসাইট চিহ্নিত করেছে। অধিকাংশ ওয়েবসাইটেই রয়েছে একটি বৃত্তাকার আইকন ও এমএফএস লোগোসহ সমান লেআউট। এসব ওয়েবসাইটের নিবন্ধনের সময়কাল ২০২৫ সালের এপ্রিল-মে মাসে এবং অনেকগুলোর রেজিস্ট্রেশন হয়েছে একই রেজিস্ট্রার ও হোস্টিং কোম্পানি—পিডিআর লিমিটেড—এর মাধ্যমে।
প্রতারণার কৌশলে একটি সাধারণ চিত্র দেখা যায়—প্রথমে একটি ভিডিওর মাধ্যমে প্রলুব্ধ করা হয়, যেখানে বলা হয়, বিজ্ঞাপন দেখে প্রতিদিন ২০০-৫০০ টাকা আয় করা সম্ভব। তবে তার জন্য একটি নির্দিষ্ট ‘প্যাকেজ’ কিনতে হবে। যেমন, ‘ভিআইপি ১’ প্যাকেজে ৫০০ টাকা জমা দিয়ে প্রতিদিন ২০০ টাকা আয়, আর ‘ভিআইপি ২’ প্যাকেজে ১ হাজার টাকা জমা দিয়ে প্রতিদিন ৪০০ টাকা আয় করা যাবে। এসব ভিডিওতে জনপ্রিয় ইউটিউবারদের আসল ভিডিওর ক্লিপের অংশ ব্যবহার করে বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়।
ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা ভিডিওগুলোর শুরুর ৩০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট পর্যন্ত সময় ব্যবহার করা হয়েছে দুইটি জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেলের নির্মিত কনটেন্টের ক্লিপ। যেখানে কৌশলে অর্থ উপার্জনের কথা থাকলেও কোথাও ওয়েবসাইটে নিবন্ধন বা টাকা জমা দেওয়ার কথা বলা হয়নি। এসব ক্লিপের পরে মোবাইল স্ক্রিন রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে ভুয়া ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খোলার ও টাকা পাঠানোর বিষয়টি দেখানো হয়।
এই প্রতারণামূলক পেজগুলোর পোস্টে মন্তব্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখেছেন, যেসব মন্তব্য ‘ইতিবাচক’ বলে মনে হয়, সেগুলোর অধিকাংশই ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে করা। ১০টি পেজের ৪ হাজার ৮০৯টি মন্তব্যের ৭৯ শতাংশই ছিল ঘুরেফিরে করা একই বক্তব্য। সবচেয়ে সাধারণ মন্তব্য ছিল, ‘আমি ৫০০০ টাকা মেম্বারশিপ ৩ দিন আগে অ্যাকটিভ করলাম। এখন পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছি।’ এই মন্তব্যটি করা হয়েছে ৮৬টি ভিন্ন ভিন্ন প্রোফাইল থেকে।
ডিসমিসল্যাব ৬৪টি এমন প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে দেখেছে, এগুলোর প্রায় সবই ভুয়া। এদের অ্যাকাউন্টে নেই কোনো পোস্ট, বন্ধুর সংখ্যা ৫০-এর নিচে এবং প্রোফাইল তথ্য একেবারে ফাঁকা। বার্তা পাঠালে কোনো জবাব মেলে না।
এমন প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন ফেসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডস ও অ্যাড পলিসি ভঙ্গ করছে। তবুও এসব ঠেকাতে মেটা এখনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও দৃক আইসিটি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম আলতাফ হোসেন বলেন, “এটি সুসংগঠিত সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের কাজ। এদের পেজগুলোতে থাকা মন্তব্য বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, কিভাবে সাজানো প্রশংসা ব্যবহার করে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন বলেন, ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাবের কারণে শিক্ষিত মানুষরাও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। তিনি বলেন, “ব্যক্তি পর্যায়ের সচেতনতার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রচারণার প্রয়োজন আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও এ ধরনের প্রতারণা ঠেকাতে নিয়মিত তদারকিতে থাকতে হবে।”
ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মে অবাধে প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার এবং সাধারণ মানুষের আর্থিক ক্ষতি ঠেকাতে জরুরি হয়ে পড়েছে সাইবার নিরাপত্তা জোরদারকরণ, মিডিয়া লিটারেসি বৃদ্ধি, এবং ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কার্যকর নীতি বাস্তবায়ন। প্রতারকেরা যতই পন্থা পাল্টাক, প্রতিটি ব্যবহারকারী যদি সচেতন হন, তবেই এই ডিজিটাল প্রতারণার বেড়াজাল ভাঙা সম্ভব।