বিজ্ঞাপন
একটি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার বিরুদ্ধে, চারটি সশস্ত্র বাহিনীর বিপক্ষে নিরস্ত্র ছাত-জনতার মোকাবেলা, দৃপ্ত প্রত্যয়ে লড়াই করে যেদিন শিক্ষার্থীরা যৌথ বাহিনীকে পরাস্ত করে অর্জন করেছিল চব্বিশের প্রথম ' স্বাধীন ক্যাম্পাস '— সেই দিনটি আজ।
সেদিন সকালের আলো পুরোপুরি স্ফুটিত হওয়ার আগেই শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে ফেলে রাষ্ট্রীয় চার বাহিনী—পুলিশ, র্যাব, এপিবিএন ও বিজিবির যৌথ বাহিনী। চারপাশে টহল, অস্ত্রের ঝনঝন, নির্ভীকতার বিপরীতে এক আতঙ্কগ্রস্ত নীরবতা। সশস্ত্র বাহিনীর ত্রাসে থমকে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কোণ।
কিন্তু এরপর যা ঘটেছে, তা যেন সিনেমার চিত্রনাট্যকেও হার মানায়। রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ববি'র আহ্বায়ক রাকিব আহমেদ সেই উত্তপ্ত সকালকে স্মরণ করে বলেন,
“যৌথবাহিনী ক্যাম্পাস ঘিরে ফেলে, আমরা গেট ভেঙ্গুগে সড়কে নেমে আসি। ওরা গুলি চালায়, টিয়ারশেল ফাটায়। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীরা বসে থাকেনি। স্থানীয় জনতার সহায়তায় আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলি। র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, এপিবিএন—সবাই এক পর্যায়ে পরাস্ত হয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে ক্যাম্পাস ছাড়ে। সেদিন আমরা শুধু প্রতিরোধ করিনি, আমরা ইতিহাস লিখেছি।
আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক সুজয় শুভ সেই দিনের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, সড়ক অবরুদ্ধ থাকায় আমরা নদী পার হয়ে গ্রামের মধ্য দিয়ে হেঁটে পিছন হতে গোপনে ক্যাম্পাসে ঢুকি। অপেক্ষারত শিক্ষার্থীদের সাথে একত্র হই, তালাবদ্ধ গেট ভেঙে সড়কে নেমে আসি—আর তখনই শুরু হয় যৌথ বাহিনীর অতর্কিত হামলা, প্রতিবাদে পাল্টা আক্রমণ করে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীরাও, পরিনত হয় রণক্ষেত্রে।”
শুরু হয় সংঘর্ষ। এক পাশে ইট, ডাল পালা, গলার স্লোগান—অন্য পাশে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট,আর ছোঁড়া বুলেট। রক্তাক্ত হয় শিক্ষার্থীদের শরীর, কিন্তু চূর্ণ হয় না তাদের মনোবল।
সংঘর্ষ চলে টানা আড়াই ঘণ্টা। আহত হন দুই শতাধিক শিক্ষার্থী, মসজিদের মিনারের আহ্বানে শিক্ষার্থীদের সাথে যোগ দেন স্থানীয় জনগন। তরাও আহত হন পুলিশের নির্মমতায়।
শুভ বলেন,
“এমন একজন ছিলেন—বিল্লাল ভাই, স্থানীয় অটোরিকশাচালক, যিনি ওই সংঘর্ষে চিরতরে দৃষ্টি হারান। অনেকে গুরুতর আহত হন। তবু থেমে যায়নি লড়াই। ‘রাষ্ট্রীয় চার বাহিনী’ তীব্র প্রতিরোধের মুখে বলতে বাধ্য হয়— আর হামলা নয়। ক্যাম্পাসে আর হামলা করবে না মর্মে আত্মসমর্পন করে ক্ষমা চেয়ে ক্যাম্পাস এরিয়া ছেড়ে শহরে অভিমুখে পদযাত্রা করেন। আমরা তাদের গার্ড দিয়ে দপদপিয়া সেতু পার করে দিই—এটাই ছিল বর্বরতার মুখে আমাদের সভ্য প্রতিশোধ।”
মুহুর্তেই মিডিয়া পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পরে এই ঘটনা। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিত হয় জুলাইয়ের প্রথম স্বাধীন ক্যাম্পাস হিসেবে।
সেদিন শুধু পুরুষ শিক্ষার্থীরাই লড়েনি, নারী শিক্ষার্থীরাও ছিলেন সেই প্রতিরোধের অগ্রভাগে— লড়াইয়ে, আহতদের সেবা- সুশ্রুষায় তাদের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। অনেক নারী শিক্ষার্থী আহতও হয়েছিলেন সেদিন। । তাদের কেউ কেউ সেদিন রক্তাক্ত হন, কেউ ক্লান্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন—তবু কেউ পিছু হটেননি।
আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী মোকাব্বেল জানান সেই পূর্বরাতের কথাগুলো—
“আমরা রাতে হলের ছাদে ইট আর লাঠি মজুত করি। নিঃসঙ্গ হলেও ভয় পাইনি। মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা হয়—জনগণকে পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান। আর সকালে হাজারো শিক্ষার্থী পতাকা হাতে, স্লোগানে মুখর হয়ে মাঠে নামে। মেয়েরা তখন হল গেইটের তালা ভেঙে বের হয়ে আসে। ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে যুদ্ধের ময়দান।”
যৌথবাহিনী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে বুলেট-টিয়ারশেল ছুড়েছিল। একের পর এক আহত হতে থাকে শিক্ষার্থী। চারপাশে শুধু ধোঁয়া আর কান্না। কিন্তু প্রতিরোধ থেমে থাকেনি।
“আল্লাহর রহমতে, স্থানীয় জনতার অশেষ সহায়তায় আমরা যৌথবাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলি,শেষ পর্যন্ত তারা আত্মসমর্পণ করে। এবং প্রথমবারের মতো জুলাইয়ে দেশে পুলিশের একটি বাহিনী শিক্ষার্থীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে ক্যাম্পাস ছাড়ে।”
স্থানীয়দের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি আরো বলেন,
“কর্ণকাঠির মা-বোনেরা নিজের হাতে রান্না করা খাবার নিয়ে এসে আমাদের খাইয়েছেন। নিজের সন্তান ভেবে আমাদের যত্ন করেছেন। এই মায়া আমরা কোথায় পাব? তারা আমাদের রক্তের আত্মীয় না হলেও আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছিলেন সেদিন। তাদের এই অবদান আমরা কখনো ভুলবো না।
সেদিনের সংঘর্ষে আহতদের একজন হাসনাত আবুল আলা, ৫০ টির অধিক ছোড়া বুলেট বিদ্ধ মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষার্থী জানান সেদিনের নৃশংসতার কথা। তিনি বলেন, “ওদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, আমাদের হাতে লাঠি আর ইট। আমাদের কাছে ছিল অসীম সাহস আর প্রতিবাদী হিম্মত। ওরা ভেবেছিল দমন করবে, কিন্তু আমরাই তাদের নতজানু করে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য করি।”
১৮ জুলাই—এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার দাবিও ওঠেছে। আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী মোকাব্বেল বলেন, “এই দিনটিকে ‘সশস্ত্র বাহিনী আত্মসমর্পণ দিবস’ হিসেবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। আমরা রক্ত দিয়েছি, ঘাম দিয়েছি, সাহসীকতার সাথে লড়েছি—এই ক্যাম্পাস স্বাধীন করেছি। তার স্বীকৃতি পাওয়া উচিত,আশা করি প্রশাসন আমাদের ত্যাগকে স্বীকৃতি দিবো,স্মরণ রাখবে। "
১৮ জুলাই যেদিন রাষ্ট্র ক্যাম্পাস গুলো দখল করতে চেয়েছিল, যখন দেশের একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তখন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হল ছাড়েনি, ক্যাম্পাস ছাড়েনি, মনোবল হারায়নি। কঠোর লড়াইয়ে পরাস্ত করে যৌথ বাহিনীকে। ববি শিক্ষার্থীরা সেদিন সেই দখল ঠেকিয়ে বলেছিল—“এ ক্যাম্পাস আমাদের, তোদের না।”
আর এই একগুচ্ছ সাহসী কণ্ঠ, কিছু রক্তাক্ত দেহ আর উৎকন্ঠা আর অদম্য প্রত্যয়ের নামেই আজ জুলাই ইতিহাসের পাতায় লেখা:
“বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীন ক্যাম্পাস—বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
-মোঃআশিকুল ইসলাম, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি