বিজ্ঞাপন
ফারুয়া বাজার থেকে যমুনাছড়ির দূরত্ব প্রায় ১৪ কিলোমিটার, আর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭৪ কিলোমিটার। কিন্তু এখানে নেই কোনো সড়ক যোগাযোগ। শুকনো মৌসুমে পায়ে হেঁটেই ফারুয়া বাজারে যেতে হয় গ্রামবাসীকে। কৃষিপণ্য বাজারজাত করা থেকে শুরু করে অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া—সব ক্ষেত্রেই চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের। ফারুয়া ইউনিয়নে মোবাইল টাওয়ার না থাকায় এলাকাবাসী নেটওয়ার্ক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। স্যাটেলাইট সংযোগের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকে সীমিত ইন্টারনেট থাকলেও গতি এত ধীর যে শুধু টেক্সট বার্তা আদান-প্রদানই সম্ভব।
১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত যমুনাছড়ি বম পাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি একাধিকবার পুনর্নির্মাণ হলেও এখনো জাতীয়করণ হয়নি। বর্তমানে অভিভাবকদের অর্থায়নে দুইজন শিক্ষক দিয়ে ৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে কোনোভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য রয়েছে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক। কিন্তু নরমাল ডেলিভারির জন্য অভিজ্ঞ ধাত্রী নেই, ফলে অদক্ষ ধাত্রীদের দ্বারাই প্রসব করাতে হয়। জরুরি রোগীকে উপজেলা সদর হাসপাতালে নিতে গেলে অনেক সময় পথে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এডিবির অর্থায়নে একটি গ্রাভিটি ফ্লো সিস্টেম (জিএফএস) থাকলেও ফিল্টার নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বাসিন্দাদের অপরিশোধিত পানি পান করতে হয়। শুকনো মৌসুমে পানি সরবরাহও কমে যায়। নিরাপদ পানির জন্য ডিপ টিউবওয়েল স্থাপনের দাবি জানিয়েছে গ্রামবাসী। বিদ্যুৎ সুবিধা এখানে নেই বললেই চলে।
যমুনাছড়ি ব্যাপটিস্ট চার্চের যাজক রবার্ট বম বলেন, “আমাদের একমাত্র আয়ের উৎস কৃষি। কিন্তু আগের মতো ফলন হয় না। সড়ক না থাকায় উৎপাদিত পণ্য বাজারে নিতে ভয়াবহ ভোগান্তি পোহাতে হয়।”
হেডম্যান রিনলম (পালম) বম জানান, “১৯৮০ সালে গ্রামটি গড়ে ওঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত বড় কোনো সরকারি উন্নয়ন হয়নি। মাত্র দেড় কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করলেই যমুনাছড়ি মূল সড়কের সঙ্গে যুক্ত হতে পারত।” তিনি আরও বলেন, “খাবার পানির জন্য একমাত্র জিএফএস-ও এখন অনুপযোগী। ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন জরুরি।”
ফারুয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মালসম পাংখোয়া বলেন, “আমাদের একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়টি এখনো জাতীয়করণ হয়নি। সরকারের সহযোগিতা ছাড়া শিক্ষার সমস্যা দূর করা সম্ভব নয়।”
ফারুয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিদ্যালাল তঞ্চঙ্গ্যা জানান, “তারাছড়ি থেকে তাংখুইতাং যাওয়ার রাস্তাটির মাঝখানে যমুনাছড়ি বম পাড়ার সংযোগে প্রায় ২-২.৫ কিলোমিটার কাঁচা পাহাড়ি রাস্তা রয়েছে। এটি এইচবিবি বা আরসিসি দিয়ে নির্মাণ করা গেলে সরাসরি গাড়ি চলাচল সম্ভব হবে। পাশাপাশি ৪০-৫০ মিটার দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণ করলেই গ্রামবাসীর যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন সহজ হবে।”
তিনি আরও বলেন, “মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, টিসিবি কার্ড সক্রিয়করণসহ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা থেকে মানুষ বঞ্চিত।”
দূর্গম এলাকায় প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে বিলাইছড়ি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (অ:দা:) মিলন চাকমা জানান, “প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবনা জমা দিলে অফিস থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া হবে।”
গ্রামবাসীর ভাষ্য, “শহরে গেলে মনে হয় রঙিন জগতে আছি, কিন্তু এখানে ফিরে আসলে মনে হয় আমরা যেন পৃথিবীর বাইরের কোনো জগতে বাস করছি।” সড়ক, বিদ্যুৎ, নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্য ও নেটওয়ার্ক—সবক্ষেত্রেই সরকারি সহযোগিতা না পেলে এই চিত্র বদলাবে না।
সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো দ্রুত উদ্যোগ নিলে যমুনাছড়ি বম পাড়া আর ‘ভিন্ন জগৎ’ নয়, উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত হবে—এমনটাই প্রত্যাশা এখানকার পাহাড়ি বাসিন্দাদের।
প্রতিবেদক- অসীম চাকমা, বিলাইছড়ি, রাঙামাটি।
জনপ্রিয়
বিজ্ঞাপন
পরবর্তী সংবাদ লোড হচ্ছে...