বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ছবি: সংগৃহীত
বিজ্ঞাপন
সেই থেকে জাতীয় রাজনীতির দৃশ্যপটেই শুধু নয়, অন্তরালের কৌশল নির্ধারণেও তিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ এক শক্তি।
বর্তমানে দীর্ঘদিন ধরে নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন খালেদা জিয়া। রাজনীতির মাঠে তার সরাসরি উপস্থিতি কমে এলেও দলীয় সিদ্ধান্ত, কৌশল নির্ধারণ এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে তিনি এখনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন—যা দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে একধরনের অনুপ্রেরণা।
বিএনপির নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়া এখন আর ‘সক্রিয় রাজনীতিতে’ নেই—তবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তার অংশগ্রহণ এখনও রয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিয়মিত তার সঙ্গে পরামর্শ করে থাকেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার পরামর্শকে দলীয় নীতিনির্ধারণের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা দিয়ে বিএনপির নীতিগত ভারসাম্য রক্ষা করছেন তিনি। অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, “খালেদা জিয়া রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। তার অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি এখনও বিএনপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।”
২০২৩ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফ করেন। এরপর থেকে খালেদা জিয়া বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও ইস্যুতে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে দলীয় নেতাকর্মী ও দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তব্য দিচ্ছেন।
জুলাই মাসে ‘গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি ভিডিও বার্তায় বলেন, “জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করুন। দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।” এরপর লালন শিল্পী ফরিদা পারভীনের খোঁজ নেওয়া থেকে শুরু করে উত্তরায় বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে দলীয় নেতাদের পাশে দাঁড়াতে নির্দেশ দেন তিনি।
২১ জুলাই গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভুটানের রাষ্ট্রদূত দাশো খারমা হামু দর্জি। এর আগে যুক্তরাজ্য, নেপাল, পাকিস্তান, চীন ও সৌদি আরবের কূটনীতিকরাও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বিএনপি বলছে, এসব সাক্ষাৎ সৌজন্যমূলক হলেও দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক দিক আলোচনায় আসছে।
চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা শামা ওবায়েদ বলেন, “দীর্ঘদিন কারাবন্দি ও অসুস্থ থাকার পর এখন তিনি কিছুটা সুস্থ হয়েছেন। ফলে যেসব কূটনীতিক তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছেন, তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন।”
সাম্প্রতিক সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো ১৩ জুন লন্ডনে তারেক রহমান ও অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক। বিএনপির সূত্র বলছে, এই বৈঠক নিয়ে যখন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, তখন খালেদা জিয়া তার অভিজ্ঞতা ও কৌশলে তা এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখেন। এই ঘটনাকে রাজনৈতিক মহলে তার ‘নীরব কূটনীতির’ উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
প্রায় চার দশকের রাজনৈতিক জীবনে খালেদা জিয়া কখনও কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি। সর্বশেষ ২০০৮ সালে তিনটি আসনে জয়ী হন তিনি। এরপর ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে এবং ২০১৮ সালে দণ্ডপ্রাপ্ত থাকায় তিনি অংশ নিতে পারেননি।
তবে বিএনপি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৬ সালের সম্ভাব্য ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি অংশ নিতে পারেন। এমনকি এবার একইসঙ্গে তারেক রহমানও নির্বাচনে অংশ নেবেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের আসন থেকে খালেদা জিয়া প্রার্থী হতে পারেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া এখন শুধুমাত্র ইতিহাসের চরিত্র নন—তিনি এখনও জীবন্ত রাজনৈতিক ব্যঞ্জনার প্রতীক। রাজপথে না থাকলেও, তিনি নীতিনির্ধারণের ভরকেন্দ্র। অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা ও কৌশল দিয়ে দলের দিকনির্দেশক ভূমিকায় রয়ে গেছেন।
যতদিন রাজনীতি থাকবে, ততদিন খালেদা জিয়ার প্রভাব থাকবেই—সরাসরি হোক বা অন্তরালে।
জনপ্রিয়
পরবর্তী সংবাদ লোড হচ্ছে...