বিজ্ঞাপন
গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢামেকে সাবেক ছাত্রনেতা ও কয়েকজন চিকিৎসকের সমন্বয়ে চাঁদাবাজ চক্র গড়ে উঠেছে। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সক্রিয় রয়েছে দালালচক্র। অভিযোগ রয়েছে, এসব অনিয়মের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানলেও কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় চক্রটি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
ঢামেকের চাঁদাবাজ চক্রের সঙ্গে ছাত্রদলের বেশ কয়েকজন সাবেক নেতার নাম উঠে এসেছে। এদের মধ্যে আছেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি ও ঢামেক ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ডা. জাভেদ আহমেদ, সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. মাহমুদুল হাসান খান সুমন, ঢামেক ছাত্রদলের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ডা. বিপ্লব, সাবেক সহ-সভাপতি মারুফ হাসান রনি, তিতুমীর কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. মাসুদ ও চকবাজার থানা জাতীয়তাবাদী তরুণ দলের সাধারণ সম্পাদক মেজবাউদ্দীন সিফাত।
সরকারের দুটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডা. জাভেদ ও ডা. সুমন গত ১৫ মার্চ হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে ঢুকে পছন্দের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে টেন্ডার তদবির করেন। পরিচালক অস্বীকৃতি জানালে তারা মনঃক্ষুণ্ন হয়ে ফিরে যান। পরে ২৬ মার্চ উপপরিচালক মো. আশরাফুল ইসলামকে হোয়াটসঅ্যাপে হুমকি দেন ডা. জাভেদ।
ঢামেকের কয়েকজন চিকিৎসক অভিযোগ করেছেন, ডা. জাভেদ দলীয় তহবিলের নামে চিকিৎসকদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করতেন। মেডিকেল অফিসারদের মাসিক এক হাজার এবং আবাসিক চিকিৎসক বা সার্জনদের দেড় হাজার টাকা দিতে হতো। প্রতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে টাকা না দিলে হুমকি ও লাঞ্ছনার শিকার হতে হতো বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
বিএনপি-সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) এ বিষয়ে এক পর্যায়ে চিঠি দিয়ে চাঁদা দেওয়া-নেওয়া বন্ধের নির্দেশ দিলেও কিছু চিকিৎসক এখনও অপমানের ভয়ে চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
ডা. জাভেদ অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “কোথাও কোনো চাঁদাবাজি বা টেন্ডারবাজিতে আমি জড়িত নই। প্রাইম টিজি বা অন্য কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক নেই। বিরোধীপক্ষ অপতথ্য ছড়াচ্ছে।” সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী তিনি বর্তমানে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর ঢামেক সংলগ্ন চাঁনখারপুল এলাকায় ‘প্রাইম টিজি’ নামের ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা হয়। অভিযোগ আছে, ডা. জাভেদ, ডা. সুমন ও ডা. মনিরসহ কয়েকজন এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। তাদের এজেন্টরা হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে অন্য ক্লিনিকের এজেন্টদের মারধর, চিকিৎসক-নার্সদের হুমকি এবং রোগীদের জোর করে প্রাইম টিজিতে পরীক্ষা করাতে বাধ্য করেন।
প্রাইম টিজি ছাড়াও রিভাইভ, ঢাকা ডায়াগনস্টিক ও হেলথ এইডসহ আরও কয়েকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এজেন্টরা হাসপাতাল এলাকায় সক্রিয়। রোগীরা অতিরিক্ত ফি দিয়ে পরীক্ষার শিকার হচ্ছেন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তত ১৯ জন সক্রিয় দালাল বর্তমানে ঢামেকের গাইনি (ওয়ার্ড ২১২), জরুরি বিভাগের নিউরোসার্জারি ও সার্জারি আউটডোরে দাপটের সঙ্গে কাজ করছে। এদের মধ্যে রয়েছে জুবায়ের, দুর্জয়, নিরব, হোসেনি দালানের সুমন, মাহবুব, শামীম, মাসুদ রানা, মানিক মিয়া, দিদার, শাহীন, রনি, জোবেল জমাদ্দার, মারুফ, পলক, পারভেজ, হুমায়ুন কবির নয়ন, মোস্তাকিম, সুপন ও হাজারীবাগের সুমন।
ঢামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জানান, “তারা একাধিকবার এসে বলেছে—বিগত সময়ে বঞ্চিত ছিলাম, টেন্ডার পাইনি। আমি স্পষ্ট করে দিয়েছি, এখানে ই-জিপি পদ্ধতিতে টেন্ডার হয়। এরপর থেকে তারা আর আসেনি, তবে স্টাফদের ধমক দিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, চিকিৎসকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তার কাছে কেউ করেননি।
ড্যাব সভাপতি ডা. হারুন আল রশিদ বলেন, “ডা. জাভেদ আমাদের সদস্য হলেও চাঁদাবাজি বা টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ প্রথম শুনছি। তিনি যদি পুলিশ ক্যাডারে যোগ দিয়ে থাকেন, তাহলে আর ড্যাবে থাকার সুযোগ নেই।”
গোয়েন্দা সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে ঢামেক হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে দালালচক্রকে গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দালাল ও চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ রোগীরা। চিকিৎসক-নার্সরাও স্বাভাবিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। টেন্ডারবাজির কারণে সরকারি অর্থ অপচয় এবং নিম্নমানের চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলমান অনিয়ম ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
জনপ্রিয়
বিজ্ঞাপন
পরবর্তী সংবাদ লোড হচ্ছে...