Logo Logo

বাংলাদেশের ধান খাতে উৎপাদনশীলতা ও টেকসই উন্নয়নের ভারসাম্য


Splash Image

বাংলাদেশে ধান শুধু একটি প্রধান খাদ্যশস্য নয়, এটি দেশের খাদ্যনিরাপত্তা, সংস্কৃতি ও গ্রামীণ জীবিকার মেরুদণ্ড। বিশ্বের অন্যতম উর্বর অঞ্চল বঙ্গীয় বদ্বীপে দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে ধানচাষের ঐতিহ্য।


বিজ্ঞাপন


প্রাচীন যুগে স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া দেশি জাতের ধান চাষ হতো, যা মূলত বৃষ্টিনির্ভর ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জাত, সেচব্যবস্থা ও প্রযুক্তির প্রসারে ধান উৎপাদনে এসেছে বিপ্লব। কিন্তু এই অতিনির্ভরতা এখন পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়নের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একসময় বাংলাদেশের কৃষকরা পাঁচ হাজারেরও বেশি দেশি ধানের জাত চাষ করতেন, যা স্থানীয় আবহাওয়া ও সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খেত। তিনটি মৌসুম: আউশ, আমন ও বোরো ধান উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখত।

আউশ মৌসুমের ধান স্বল্পমেয়াদি ও খরা সহনশীল ছিল, আমন মৌসুমের ধান প্রধানত বৃষ্টিনির্ভর, আর বোরো ধান শীতকালে রোপণ করে বসন্তে ঘরে তোলা হতো, যা তখন অবশিষ্ট বর্ষার পানির ওপর নির্ভর করত। সেচ, রাসায়নিক সার ও আধুনিক যন্ত্রপাতির আগমনের আগে কৃষকরা জৈব সার, ফসল পর্যায়ক্রম ও ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে মাটির উর্বরতা রক্ষা করতেন।

ষাটের দশকের সবুজ বিপ্লব এবং ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ধানচাষে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে। আধুনিক জাত, সেচব্যবস্থা ও যান্ত্রিকীকরণ ধান উৎপাদনে বিপুল অগ্রগতি আনে। নব্বইয়ের দশকে ব্রি ধান-২৮ ও ব্রি ধান-২৯ উদ্ভাবনের পর বোরো মৌসুমে উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১১.৬৮ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয় এবং বছরে প্রায় ৪১ মিলিয়ন মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হয়। এর অর্ধেকেরও বেশি আসে বোরো মৌসুম থেকে, যা শতভাগ সেচনির্ভর। ব্রির তথ্যমতে, আধুনিক জাতের ব্যবহার এখন আউশে ৯৪ শতাংশ, আমনে ৯০ শতাংশ এবং বোরোতে প্রায় ১০০ শতাংশ। যদিও এই সাফল্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, তবে একই সঙ্গে তৈরি হয়েছে অতিরিক্ত সেচনির্ভরতা ও পানিসঙ্কটের আশঙ্কা।

উত্তরাঞ্চলে এক কেজি বোরো ধান উৎপাদনে গড়ে ১,৬০০ লিটার পানি লাগে। কিন্তু শুকনো মৌসুমে বৃষ্টিপাত মাত্র সাত শতাংশ হওয়ায় কৃষকরা গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি তুলছেন। এই অনবরত উত্তোলন বারিন্দ অঞ্চলের পানিস্তর দ্রুত নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, বর্তমান হারে পানি উত্তোলন অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির গভীরতা দ্বিগুণ হয়ে যাবে, যা কৃষি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করবে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য এখন প্রয়োজন কৌশলগত ভারসাম্য। কৃষি অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, বোরো নির্ভরতা কমিয়ে বৃষ্টিনির্ভর আউশ ও আমন মৌসুমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। বর্তমানে প্রায় ০.৪৩ মিলিয়ন হেক্টর জমি আউশ মৌসুমে পতিত থাকে। আধুনিক স্বল্পমেয়াদি জাত ব্যবহার করে এই জমিগুলোকে আবাদযোগ্য করা সম্ভব।

হিসাব অনুযায়ী, বোরোর আবাদ পাঁচ শতাংশ কমিয়ে এবং আউশ আবাদ ১৫ শতাংশ বাড়ানো গেলে ২০৩০ সালেও মোট ধান উৎপাদন ৪১ মিলিয়ন টন বজায় রাখা সম্ভব হবে। এর ফলে পানি ব্যবহারে সাশ্রয় হবে প্রায় ৪.৭ বিলিয়ন লিটার।

এই পরিবর্তনের ফলে খাদ্যনিরাপত্তার কোনো ঘাটতি হবে না। ২০৩০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে প্রায় ১৯ কোটি এবং তাদের জন্য প্রয়োজন হবে আনুমানিক ২৮ মিলিয়ন টন চাল। ফলে ১৩ মিলিয়ন টন উদ্বৃত্ত চাল বীজ, পশুখাদ্য ও শিল্পখাতে ব্যবহার করা যাবে। পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্য এবং চাল রপ্তানির নতুন সম্ভাবনাও তৈরি হবে।

এখন প্রয়োজন নীতিমালা, প্রযুক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার সঠিক সমন্বয়। জলবায়ু সহনশীল জাত উদ্ভাবন, সেচ দক্ষতা বৃদ্ধি, যান্ত্রিকীকরণ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কৃষকদের আধুনিক আউশ ও আমন জাত ব্যবহারে প্রণোদনা দিতে হবে এবং পরিবেশবান্ধব চাষাবাদে তাদের সহায়তা করতে হবে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে যাতে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়।

বাংলাদেশের ধানচাষের ইতিহাস মূলত অভিযোজন ও উদ্ভাবনের ইতিহাস। বোরো ধানের প্রসার আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা দিয়েছে, কিন্তু এর ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয় ঘটেছে। এখন সময় এসেছে উৎপাদনশীলতা ও টেকসই উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য আনার। প্রজ্ঞাপূর্ণ নীতি, গবেষণা ও কৃষকের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ এমন একটি ধানচাষব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে, যা শুধু উৎপাদন বাড়াবে না- প্রকৃতি, পানি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষাও নিশ্চিত করবে।

লেখক: ড. মো. আব্দুস সালাম, প্রধান কৃষি অর্থনীতিবিদ ও উপ-পরিচালক (এইচআরডি), পার্টনার প্রোগ্রাম, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি), ঢাকা।

বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন

আরো দেখুন


বিজ্ঞাপন

পরবর্তী সংবাদ লোড হচ্ছে...