বিজ্ঞাপন
মহাবিশ্বকে আমরা দেখি আলো দিয়ে, কিন্তু আলোর বাইরেও আছে বিশাল অদৃশ্য সাম্রাজ্য, যা আমরা দেখতে পাই না, স্পর্শ করতে পারি না, এমনকি কোনো তড়িৎচৌম্বক বিকিরণও তা নিঃসরণ করে না। তবুও এই অদৃশ্য উপাদানই মহাবিশ্বকে “ধরে” রেখেছে। এই পরস্পরবিরোধী সত্যই ডার্ক ম্যাটারকে আজকের বিজ্ঞানের সবচেয়ে কঠিন ও গভীর রহস্যে পরিণত করেছে।
মহাবিশ্বের দৃশ্যমান অংশ—মাত্র ৫ শতাংশ!
বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ—গ্যালাক্সির ঘূর্ণন, নক্ষত্রদের কক্ষপথ, মহাজাগতিক কাঠামোর বিন্যাস—সবই বলে যে মহাবিশ্বে দৃশ্যমান পদার্থ খুব অল্প। বৈজ্ঞানিক অনুমান অনুযায়ী, পুরো মহাবিশ্বে আমরা যা দেখি—গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, গ্রহ, ধূলিকণা—এসব মোট ভর–শক্তির মাত্র ৫ শতাংশ।
অপরদিকে, ডার্ক ম্যাটার প্রায় ২৭ শতাংশ দখল করে আছে। বাকি অংশ ডার্ক এনার্জি, যার রহস্য আরও ঘন কুয়াশায় মোড়া।
এই হিসাবেই বোঝা যায়, আমরা আসলে একটি “অদৃশ্য মহাবিশ্বে” বাস করছি—দেখা জগৎ শুধু তার পাতলা আবরণ।
ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি কীভাবে টের পাই?
যে পদার্থ আলো দেয় না বা আলো শোষণও করে না, তাকে শনাক্ত করা অসম্ভব মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বিজ্ঞানের বিশেষত্ব হলো—সরাসরি না দেখা গেলেও প্রভাব দেখে অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়। গ্যালাক্সির প্রান্তের নক্ষত্রদের গতি দৃশ্যমান ভরের তুলনায় অস্বাভাবিক দ্রুত। গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের ভর পুরোটাই ব্যাখ্যা করা যায় না শুধু দৃশ্যমান পদার্থ দিয়ে। গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং—দূরবর্তী নক্ষত্রের আলো বেঁকে যায় অদৃশ্য ভরের কারণে। এই সব পর্যবেক্ষণ যেন এক সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়: মহাবিশ্বে অদৃশ্য কোনো বিশাল ভর কাজ করছে।
কী দিয়ে তৈরি ডার্ক ম্যাটার? বিজ্ঞানী সমাজে তীব্র বিভাজন
এ প্রশ্নটির উত্তরই আজকের বিজ্ঞানকে সবচেয়ে বেশি তাড়িত করছে। কোটি কোটি ডলার গবেষণায় ব্যয় হচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ডিটেক্টর কাজ করছে পাহাড়, বরফস্তর কিংবা ভূগর্ভের গভীরে—তবুও উত্তর এখনো দুর্লভ।
বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সম্ভাব্য কণার কথা বলছেন, যেমন- WIMP (Weakly Interacting Massive Particles), Axion, Sterile Neutrino ও Super Symmetric কণা।
কিন্তু এখনো কোনোটি প্রমাণিত নয়। বিজ্ঞান এখানে একধরনের বৈপরীত্যের মুখোমুখি—যতই খোঁজা হচ্ছে, ততই প্রশ্ন বাড়ছে।
ডার্ক ম্যাটারের উৎপত্তি—বিগ ব্যাং-এর ছায়ায় জন্মানো রহস্য
মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে, বিগ ব্যাং-এর প্রথম সেকেন্ডগুলোতে, প্রচণ্ড তাপ ও ঘনত্বের মধ্যে অসংখ্য কণা সৃষ্টি হয়েছিল। ডার্ক ম্যাটার সেই বিশৃঙ্খল প্রাথমিক পর্যায়েই জন্ম নিয়েছিল কি? নাকি এটি মহাবিশ্বের আরও প্রাচীন কোনো নিদর্শন?
কোনো তত্ত্বই এখনো নিশ্চিত নয়।
এখানে এক গভীর প্রশ্ন লুকিয়ে আছে—ডার্ক ম্যাটার যদি বিগ ব্যাং-এর চেয়েও পুরোনো হয়, তবে আমাদের মহাবিশ্বকেই নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে।
কেন এই রহস্য সমাধান এত গুরুত্বপূর্ণ?
ডার্ক ম্যাটারের উত্তর পাওয়া মানে শুধু একটি বৈজ্ঞানিক সমস্যার সমাধান নয়। এটি সমাধান হলে— গ্যালাক্সির গঠন সম্পর্কে নতুন তত্ত্ব তৈরি হবে। মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ প্রসারণের ধরণ বোঝা যাবে। নতুন পদার্থবিজ্ঞানের সম্ভাবনা তৈরি হবে। প্রচলিত কণা-তত্ত্ব বদলে যেতে পারে। সম্ভবত নতুন ধরনের কণা বা ফোর্সের সন্ধান মিলবে। এ এক নতুন বৈজ্ঞানিক যুগের সূচনা।
বিজ্ঞান যেখানে অদৃশ্যের অর্থ খুঁজছে
মূল কথা হলো—মানুষ চোখ দিয়ে শুধু যে দেখে, তার বাইরে আরও বড় জগৎ আছে। ডার্ক ম্যাটার সেই অদৃশ্য জগতের প্রতিনিধি। আলোকে কেন্দ্র করে তৈরি আমাদের সমস্ত বিজ্ঞানই এখানে চ্যালেঞ্জের মুখে।
ডার্ক ম্যাটার শুধু একটি বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন নয়; এটি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতার প্রমাণ। আমরা যা দেখি, তা-ই সব নয়—এই সত্যটিকে মহাবিশ্ব প্রতিটি ধাপে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। এই রহস্যের সমাধান মানেই মহাবিশ্বকে নতুন চোখে দেখা।
অতএব, ডার্ক ম্যাটার নিয়ে গবেষণা শুধু ল্যাবরেটরির সীমাবদ্ধ অনুসন্ধান নয়; এটি মানববুদ্ধির মহাযাত্রা—অন্ধকারের ভেতর থেকে আলো খুঁজে বের করার সংগ্রাম।
মহাবিশ্বের ইতিহাস, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—সবকিছু বোঝার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে এই অদৃশ্য উপাদান। এর রহস্য উন্মোচন হবে—মানবসভ্যতার জ্ঞানের পরবর্তী বিপ্লব।
জনপ্রিয়
বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
পরবর্তী সংবাদ লোড হচ্ছে...