মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল ছবি
বিজ্ঞাপন
এই অবস্থা বন্ধ করতে এবার নতুন এক কৌশলের ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
সোমবার (৪ আগস্ট) এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, রাশিয়া যদি আগামী শুক্রবার বা ৮ আগস্টের মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে রাজি না হয়, তবে রাশিয়ার সঙ্গে এখনো বাণিজ্য করছে—এমন দেশগুলোর ওপর ‘সেকেন্ডারি শুল্ক’ আরোপ করা হবে। এই শুল্ক অনুযায়ী, রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করা দেশগুলোর পণ্য আমদানির সময় যুক্তরাষ্ট্র শতভাগ শুল্ক আরোপ করবে।
সেকেন্ডারি শুল্কের লক্ষ্য রাশিয়ার রাজস্ব সংকোচন
তেল ও গ্যাস রাশিয়ার সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত। এর প্রধান ক্রেতা চীন, ভারত এবং তুরস্ক। এই দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতেই ট্রাম্পের এই উদ্যোগ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তিনি নিজেই বলেন, “আমি অনেক কিছুর জন্য বাণিজ্যকে ব্যবহার করেছি, কিন্তু যুদ্ধ থামানোর জন্য এটা দুর্দান্ত।”
ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য এটি নতুন নয়। এর আগেও ভেনেজুয়েলার তেল ক্রেতাদের বিরুদ্ধে একই ধরনের শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়ার বিরুদ্ধে এই কৌশল গ্রহণ করলে তা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষক কিয়েরান টম্পকিনস বলেন, “জ্বালানি দামের স্তরই হবে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে প্রভাবিত করার মূল পথ।” কারণ শুল্ক আরোপ হলে রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের সরবরাহ কমে যেতে পারে, ফলে দাম বেড়ে যাবে। ২০২২ সালে আগ্রাসনের সময় বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতির যে ঢেউ উঠেছিল, সেই রকম পরিস্থিতি ফের দেখা দিতে পারে।
তবে ট্রাম্প মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের রেকর্ড পরিমাণ তেল উৎপাদনের কারণে তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
ভারত ও চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান
২০২২ সালের পর থেকে ভারত রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল ক্রেতা। ট্রাম্প জানিয়েছেন, ভারত রাশিয়ার যুদ্ধ চালাতে সাহায্য করছে এবং তারা যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য সম্পর্ক ঝুঁকির মুখে পড়বে। ভারতের পণ্যের ওপর ইতোমধ্যেই ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসানো হয়েছে, যা আরও বাড়ানো হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন ট্রাম্প।
যদি সেকেন্ডারি শুল্ক কার্যকর হয়, তাহলে আইফোনসহ ভারতে তৈরি মোবাইল ফোন আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। এতে মার্কিন ভোক্তারা বড় ধরনের মূল্যবৃদ্ধির মুখে পড়বেন।
ভারত ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘দ্বৈত নীতির’ অভিযোগ তুলেছে। কারণ ২০২৪ সালে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেও প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে, যদিও তা আগের বছরের তুলনায় অনেক কম।
চীনের ক্ষেত্রেও একই হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের মতো অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করা সহজ হবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে পাঁচগুণ বেশি পণ্য আমদানি করে ভারতের তুলনায়। এর মধ্যে রয়েছে খেলনা, পোশাক ও ইলেকট্রনিক্সসহ বিভিন্ন ভোক্তাপণ্য।
ইউরোপেও চাপ, তবে বাস্তবতা জটিল
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তুরস্ক এখনো রাশিয়ার বড় জ্বালানি ক্রেতা। যদিও ইইউ জানিয়েছে, ২০২৭ সালের মধ্যে রাশিয়া থেকে সব ধরনের জ্বালানি আমদানি বন্ধ করবে তারা। তবে সাম্প্রতিক এক চুক্তিতে ইইউর রপ্তানি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে। সেকেন্ডারি শুল্ক কার্যকর হলে এই হার আরও বাড়বে এবং ইউরোপের রপ্তানি হুমকির মুখে পড়বে।
রাশিয়ার ‘শ্যাডো ফ্লিট’ এবং নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যাওয়া
নিষেধাজ্ঞা এড়াতে রাশিয়া ইতোমধ্যে তৈরি করেছে একটি তথাকথিত ‘শ্যাডো ফ্লিট’। অস্পষ্ট মালিকানার শত শত ট্যাংকার নিয়ে গঠিত এই ফ্লিট রপ্তানিকৃত জ্বালানির উৎস গোপন রাখতে সাহায্য করে। এতে সেকেন্ডারি নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা হ্রাস পেতে পারে।
নিষেধাজ্ঞা বিশেষজ্ঞ রিচার্ড নেফিউ বলেন, “নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেমন কঠিন, তা বজায় রাখাও ততটাই কঠিন। কারণ, লক্ষ্যবস্তু দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর নতুন নতুন কৌশল বের করে।”
রাশিয়ার অর্থনীতি: বিপরীতমুখী চিত্র
রাশিয়ার অর্থনীতি এখনো মোটামুটি স্থিতিশীল। গত বছর দেশটির প্রবৃদ্ধি ছিল ৪.৩ শতাংশ। তবে অর্থমন্ত্রী ম্যাক্সিম রিশিতনিকভ সতর্ক করে বলেছেন, অতিরিক্ত উত্তাপের কারণে দেশটি এখন মন্দার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৫ সালে রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি ০.৯ শতাংশে নেমে আসতে পারে। কারণ তেল ও গ্যাস রপ্তানি থেকে আয় কমে আসছে, যা দেশটির বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
তবু প্রেসিডেন্ট পুতিন প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়িয়ে স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে গেছেন। জিডিপির ৬.৩ শতাংশ এই খাতে ব্যয় হচ্ছে বলে ধারণা করা হয়।
অন্যদিকে ইউক্রেন তুলনামূলক ছোট অর্থনীতির ২৬ শতাংশ ব্যয় করছে এই যুদ্ধে, যার ফলে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বারবার মিত্রদের কাছ থেকে সহায়তা চেয়ে আসছেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই সেকেন্ডারি শুল্ক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে শুধু রাশিয়াই নয়, গোটা বিশ্বব্যবসা, প্রযুক্তি খাত, ভোক্তা পণ্য এবং জ্বালানি বাজারে তীব্র প্রভাব ফেলতে পারে। রাশিয়ার অর্থনীতি মন্দার মুখে পড়লেও, এই শুল্ক নীতির সরাসরি প্রভাব আরও বিস্তৃত হবে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের জন্য এর লাভ ও ক্ষতির ভারসাম্যই নির্ধারণ করবে এই নীতির ভবিষ্যৎ সফলতা।
জনপ্রিয়
পরবর্তী সংবাদ লোড হচ্ছে...