Logo Logo

এইচএসসি ২০২৫ ব্যাচের রেজাল্ট ধস নয়, এটি বাংলাদেশের শিক্ষা ও মানসিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি


Splash Image

সম্প্রতি প্রকাশিত এইচএসসি ২০২৫ ব্যাচের ফলাফল নিয়ে সারাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে হতাশা যেমন বেড়েছে, তেমনি উঠেছে প্রশ্ন—প্রতি বছরই কেন রেজাল্টে এমন ধস নামে?


বিজ্ঞাপন


ইউরোপ সাইপ্রাসের ফিলিপস ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের গবেষক ও উদ্যোক্তা মো. রিয়াজ মিয়া মনে করেন, এই ফলাফল কোনো ব্যর্থতা নয়; বরং এটি বাংলাদেশের শিক্ষা কাঠামো ও মানসিক বিনিয়োগের দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। তিনি বলেন, “আমরা অনেক আগেই উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে শিক্ষা বাজেট বাড়ানো, বিজ্ঞানচর্চা ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা চালুর উদ্যোগ নিতে পারতাম। কিন্তু বাস্তব এক্সপেরিমেন্ট ও গবেষণার সুযোগের অভাবে শিক্ষার্থীরা বইয়ের মধ্যে বন্দী হয়ে গেছে।”

ইউনেস্কোর (UNESCO, 2024) তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ শিক্ষা খাতে GDP-এর মাত্র ১.৯৮% ব্যয় করছে, যেখানে ভারত ৪.৩%, নেপাল ৩.৫% এবং ভুটান ৬.৬% ব্যয় করছে। দেশের ৬৩% কলেজে পর্যাপ্ত বিজ্ঞান ল্যাব নেই, আর ৪৭% শিক্ষক জানিয়েছেন তাঁরা পরীক্ষণ পরিচালনার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পান না। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব দেশে প্রজেক্ট-বেইজড ও এক্সপেরিমেন্টাল লার্নিং প্রচলিত, সেখানে শিক্ষার্থীদের শেখার আগ্রহ, আত্মবিশ্বাস ও উদ্ভাবনী চিন্তাধারা দ্বিগুণ হারে বেড়েছে।

রিয়াজ মিয়া বলেন, “শিক্ষা শুধু পাঠ্যবইয়ের তথ্য নয়—এটি চিন্তা ও কৌতূহলের বিকাশের প্রক্রিয়া। আমরা যদি শিক্ষা বাজেটকে কেবল ভবন ও অবকাঠামোয় সীমাবদ্ধ রাখি, তাহলে চিন্তাশক্তি ও গবেষণার সংস্কৃতি কখনোই তৈরি হবে না।”

আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (APA, 2023) তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে প্রায় ৬৮% শিক্ষার্থী নিয়মিত স্ট্রেস ও পারফরম্যান্স-এনজাইটি অনুভব করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৭৮% শিক্ষার্থী মনে করে তাদের মানসিক চাপের মূল কারণ ফলাফল-কেন্দ্রিক শিক্ষা, আর ৫৬% শিক্ষার্থী পর্যাপ্ত কাউন্সেলিং ও গাইডেন্সের অভাবকে দায়ী করেছে।

 রিয়াজ মিয়া বলেন, “শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্ক এখন এমন এক চাপের ঘরে বন্দী, যেখানে ভুল করার ভয়ই তাদের শেখার আগ্রহ কেড়ে নিচ্ছে। তাই আমাদের শিক্ষা কাঠামোয় মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং ও ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স ট্রেনিং অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।”

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (WEF, 2024) তথ্যমতে, আগামী ১০ বছরে বিশ্বের ৮৫% নতুন চাকরি তৈরি হবে AI, বায়োটেকনোলজি, ডেটা সায়েন্স ও ডিজিটাল রিসার্চ খাতে। কিন্তু বাংলাদেশে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে মাত্র ১২% শিক্ষার্থী কখনও কোনো বাস্তব গবেষণা বা প্রজেক্টে অংশ নিয়েছে। রিয়াজ মিয়া মন্তব্য করেন, “শিক্ষার্থীর হাতে যদি ল্যাব, টুলস ও দিকনির্দেশনা না থাকে, তাহলে আমরা শুধু সার্টিফিকেট তৈরি করব, দক্ষ মানুষ নয়। সময় এসেছে গবেষণাকে বিলাসিতা নয়, বরং অপরিহার্য বিনিয়োগ হিসেবে ভাবার।”

রিয়াজ মিয়ার মতে, ২০২৫ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের এক ‘ট্রানজিশন জেনারেশন’—যারা কোভিড-পরবর্তী অনলাইন শিক্ষা, সামাজিক চাপ ও প্রযুক্তি-বিপ্লবের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। তিনি বলেন, “২৫ ব্যাচ, তোমরা এমন এক সময়ের সন্তান, যখন পৃথিবী দ্রুত বদলাচ্ছে। ব্যর্থতা তোমাদের ভাঙার নয়, গড়ার পাঠ দেবে। নিজের উপর বিশ্বাস রাখো, উদ্দেশ্য সৎ রাখো—তাহলে যেকোনো জায়গা থেকে কামব্যাক করতে পারবে, ইনশাআল্লাহ।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের শিক্ষা কাঠামো এখনই পুনর্গঠনের দাবি রাখে। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, গবেষণার জন্য জেলা-উপজেলায় বাজেট বরাদ্দ দেওয়া এবং ডিজিটাল ও সৃজনশীল শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।

শিক্ষা মানে কেবল পরীক্ষার ফল নয়—এটি একটি মানবিক, সৃজনশীল ও গবেষণাভিত্তিক ভবিষ্যৎ সমাজ গঠনের হাতিয়ার। সময় এসেছে ফলাফলের হিসাব নয়, ভবিষ্যতের চিন্তা করতে।

-গোবিপ্রবি প্রতিনিধি: হাবিবুর রহমান

বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন

আরো দেখুন


বিজ্ঞাপন

পরবর্তী সংবাদ লোড হচ্ছে...